প্রেমের ফাঁদে ফেলে হত্যার পর লাশ গুম, প্রেমিক গ্রেপ্তার
নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি :
স্বামী পরিত্যক্তা এক নারীকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপন করে হত্যার পর লাশ গুমের ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশন পিবিআই। হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ চার মাস পর প্রেমিককে গ্রেপ্তার করলে তার স্বীকারোক্তিতে বেরিয়ে এসেছে হত্যাকাণ্ডের চাঞ্চল্যকর তথ্য। নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে এ ঘটনা ঘটে।
শনিবার দুপুরে পিবিআই জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম তার কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে গণমাধ্যমকে এসব তথ্য জানান। এ সময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন নিহত নারী ফাতেমার পরিবারের স্বজনরা।
স্বজনরা জানান, আড়াইহাজার উপজেলার গহরদি থানার সাকিন এলাকার দরিদ্র দম্পতি বিল্লাল হোসেন ও সামছুন নাহারের বড় সন্তান ফাতেমা ছোটবেলা থেকেই পার্শ্ববর্তী গ্রাম মানিকপুরে নানার বাড়িতে থেকে বড় হয়। কিশোরি বয়স থেকেই মামা ইলিয়াস মোল্লার ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খাবার হোটেলের রান্নার কাজে সহায়তা করতো ফাতেমা। পরে মামা নিজের পছন্দমতো ফাতেমাকে বিয়ে দিলেও স্বামী শারিরীক ও মানসকি ভারসাম্যহীন হওয়ায় বিয়ের এক সপ্তাহ পর ফাতেমাকে ডিভোর্স করিয়ে নিজের বাড়িতে নিয়ে আাসেন তিনি।
এদিকে ওই বাড়ি সংলগ্ন প্রতিবেশি মালয়েশিয়া প্রবাসি যুবক ইউনুছ আলী মহামারি করোনায় লকডাউনের কারণে গত ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফিরে আসেন। একপর্যায়ে ফাতেমার সাথে প্রেম ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে তোলেন। তাদের মধ্যে পাঁচ মাস ধরে শারীরিক সম্পর্ক চলে। বিষয়টি ইউনুছের পরিবার জানতে পেরে তালাকপ্রাপ্ত নারীর সাথে এই সম্পর্ক মেনে না নিয়ে ইউনুছকে অন্যত্র বিয়ে করনোর চেষ্টা করতে থাকেন তারা। অন্যদিকে অন্ত:সত্ত্বা ফাতেমাও বিয়ের জন্য চাপ দিলে উভয়দিক থেকে পরিত্রাণ পেতে ফাতেমাকে হত্যার পরিকল্পনা করে ইউনুছ।
সেই পরিকল্পনা মোতাবেক গত ১০ আগস্ট রাত দশটার দিকে ইউনুছ ফাতেমাকে ফোন করে বিয়ের কথা বলে তাদের বাড়ির পেছনে নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে শারীরিক সম্পর্কের পর শ্বাসরোধ করে তাকে হত্যার পর পার্শ্ববর্তী নির্মানাধীন সেমিপাকা বাড়ির ভিটি বালুর নীচে গর্ত করে লাশ গুম করে। ঘটনার ছয়দিন পর ১৬ আগস্ট সেখান থেকে পঁচা লাশের দুর্গন্ধ ছড়ালে পুলিশ অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করলে ফাতেমার স্বজনরা এসে শনাক্ত করেন।
এ ঘটনায় নিহত ফাতেমার বাবা বিল্লাল হোসেন বাদি হয়ে অজ্ঞাত ব্যক্তিদের আসমি করে হত্যা মামলা দায়ের করলে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায় নিহত ফাতেমার হত্যাকারি লম্পট প্রেমিক ইউনুছ।
এদিকে সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জানান, মামলাটির তদন্তভার পেয়ে হত্যার রহস্য উদঘাটনে অনুসন্ধান শুরু করে পিবিআই তদন্ত দল। ফাতেমার মোবাইল ফোনের কললিস্ট ও লাশের ফিঙ্গার প্রিন্টসহ প্রযুক্তির সহায়তায় শনাক্ত করে হত্যাকান্ডের মূল অপরাধি ইউনুছকে। ৮ ডিসেম্বর রাতে পিবিআই দল অভিযান চালায় সিলেট জেলার জৈন্তাপুর পাহাড়ি অঞ্চলে। সেখানকার বাংলাদেশ ভারত সীমান্ত এলাকা থেকে ইউনুছকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে সে ফাতেমাকে হত্যার বিষয়টি স্বীকার করে।
পরে ইউনুছের স্বীকারোক্তিমতে হত্যাকান্ডের আলামত উদ্ধারে তাকে নিয়ে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজারে পৃথক অভিযান চালায় পিবিআই। ইউনুছের বাড়ির পেছন থেকে লুকানো অবস্থায় উদ্ধার করে হত্যাকান্ডের পর মাটি খুঁড়ে লাশ গুমের কাজে ব্যবহৃত কোদাল। এছাড়া হত্যার পর ফাতেমার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন, কানের দুল এবং জাতীয় পরিচয়পত্র (ভোটার আইডি কার্ড) তার ওনা দিয়ে পেঁচিয়ে মেঘনা নদীতে ফেলে দেয়ার কথাও স্বীকার করেছে ইউনুছ। তবে সেগুলো উদ্ধারে অভিযানে গেলেও স্রোতের কারনে সেগুলো নদীতে তলিয়ে গেছে। যে কারণে উদ্ধার সম্ভব হয়নি বলে জানান পিবিআই পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম।
পরে আসামি ইউনুছ হত্যার দায় স্বীকার করে এ ব্যাপারে নারায়ণগঞ্জের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটট কাওছার আলমের আদালতে জবানবন্দিও দেয়। এই মামলায় ইউনুছসহ তার পরিবারের আরো ছয়জনকে অভিযুক্ত করা হয়। তবে হত্যাকান্ডে ইউনুছসহ তার পরিবারের অন্যান্য সদস্যরাও জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে মামলার অন্যান্য আসামিদের গ্রেফতারসহ দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করছেন নিহত ফাতেমার স্বজনরা।
মামলার বাদি ও নিহত ফাতেমার বাবা বিল্লাল হোসেন বলেন, ইউনুছ, তার বাবা মা, ছোট ভাই, ছোট বোন ও বোনের জামাই মিলে আমার মেয়েকে খুন করে লাশ গুম করেছিল। আমি সব আসামির গ্রেফতার এবং উপযুক্ত শাস্তি চাই।
এ ব্যাপারে পিবিআই জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম জানান, এই হত্যাকান্ডে আসামি ইউনুছের পরিবারের কেউ কেউ জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যেহেতু হত্যার পর ফাতেমার লাশ জনৈক জসীমের নির্মানাধিন সেমিপাকা বাড়ির ভিটির নীচে মাটি খুঁড়ে গুম করার পরেও ভিটি পাকা না করায় ইউনুছের বাবা মা দ্রুত করারর তাগিদ দেন এবং প্রয়োজনে যাবতীয় খরচ দিবেন বলে বাড়ির মালিককে আশ^স্ত করেন তারা। নিজের টাকা দিয়ে অন্যের বাড়ির ভিটি পাকা করে দেয়ার এমন আগ্রহ আর অতিউৎসাহে তাদের প্রতি সন্দেহ সৃষ্টি হয়েছে। সে বিষযটিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে জানিয়ে মামলার অন্যান্য আসামীদের গ্রেফতার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করা হবে বলে আশা করেন পিবিআই জেলা পুলিশ সুপার।